top of page

‘সামাটার’—এক নির্জন যাপন


চিত্র।


এখানে পাহাড়ের গায়ে সবুজ গাছের জঙ্গল। পাদদেশে নদীটি পাথরের সাথে সখ্যতা করে কুলকুল সুরে গায়। নদীর সাথে পাহাড় আর পাথরের সখ্যতার গল্পটি বেশ পুরোনো। হঠাৎ যদি সেই সখ্যতার গল্প নিজের কানে শোনার সুযোগ আসে ! তাও আবার জঙ্গলের মাঝে কোনও এক কটেজের বাঁশ আর খড়ের ছাউনি ঘেরা বর্ধিত বারান্দায় বসে,তবে কেমন হবে ব্যাপারটা ? না না এটা কল্পনা নয়। স্বপ্নের মতো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জায়গাটার বাস্তবিক অবস্থান হল দক্ষিণ সিকিমে। জোরথাং থেকে আট কিলোমিটার ভিতরে। নদীর এপার পশ্চিম সিকিম আর নদীর ওপার দক্ষিণ সিকিম। মাঝে যে নদীর গান শুনতে যাবেন, নামটি তার ‘রঙ্গীত’। এতক্ষণ ধরে যার রূপের বর্ণনা দিলাম,সেই জায়গাটার নাম ‘সামাটার’। নিউ জলপাইগুড়ি ট্রেকার স্ট্যান্ড থেকে জোরথাংগামী শেয়ারের ট্রেকার অথবা ভাড়ার গাড়িতে যেতে সময় লাগবে মাত্র তিন ঘন্টা। অফবীট এই জায়গাটিতে উইকএন্ড ট্যুর প্ল্যান করেও যাওয়া যেতে পারে।


চিত্র।


জোরথাং ছাড়িয়ে ‘পিপলে মোড়’ থেকে ডানদিকের বেশ ঢালু রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই রঙ্গীত নদীর পাথুরে চর। বাঁধ নির্মাণের জন্য নদী এখনে বেশ ক্ষীণকায়া! প্রবাহটা দক্ষিণ সিকিমের পাড় ঘেঁষে। একটা ছোট্ট ঘুন্টি দোকানের পিছন থেকে শুরু হয়েছে ঝুলন্ত ব্রিজ। এই ব্রিজ এইস্থানে পশ্চিম আর দক্ষিণ সিকিমের একমাত্র সংযোগকারী পথ। এবছর মার্চের ৩ তারিখ আমরা পৌঁছে গেলাম সামাটারের একমাত্র থাকার জায়গা “ রিভার ওয়াচ রিসর্টে”। রিসর্টের মালিক একজন রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসার। এই পাহাড়-জঙ্গল-নদী-পাথর ভরপুর প্রকৃতির টানে জীবনের বাকি ক’টা দিন কাটিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে এই রিসর্টটি তৈরি করেছেন। আমরা যখন পৌঁছালাম,তখন দুপুর বারোটা প্রায়। মাথার উপর গনগনে রোদ্দুর। সরু ঝুলন্ত ব্রিজের হালকা দুলুনি অনুভবে নিয়ে মাঝপথে এসে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে থাকা, নীচ দিয়ে বয়ে চলা সবুজ রঙ্গীতকে দু’চোখ ভরে দেখার অনাবিল সে আনন্দ, সত্যিই অবর্ণনীয়! এই ব্রিজে কোনও বাহন চলাচল হয় না।


ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে বাঁ-হাতেই রয়েছে রিসর্টে প্রবেশের প্রধান দরজা। গাছগাছালি ঘেরা ঘন জঙ্গলের মাঝে সমস্ত সুবিধাযুক্ত এই রিসর্টটি প্রথমেই মন কেড়ে নেয় এর অকৃত্রিমত প্রাকৃতিক পরিবেশ। মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হয় এখানে। ভেজা জঙ্গলের বুনো গন্ধে মন মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। এই মরশুমে ট্যুরিস্ট বলতে শুধু আমরা। ফলে নির্জনতা যেন আরও উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আমরা দু-দিনের অতিথি,কাজেই হাতে অনেক সময়। বিকেলে পায়ে পায়ে ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে নদীর চরে পাথরের উপর বসে, মাছ ধরার দৃশ্য উপরি পাওনা। আপনি সৌখিন মৎস শিকারি হলে যন্ত্রটি অনায়াসেই বহন করতে পারেন। রিসর্টে দুটি কটেজ আর তিনটি রুম আছে। আগে থেকে বুকিং বাঞ্ছনীয়। এপ্রিলের শুরুতেই এখানে স্কুল-কলেজের সামার ক্যাম্প শুরু হয়। তখন তাঁবুতে থাকারও ব্যবস্থা করা হয়।


চিত্র।


ঠিক সন্ধের মুখে নদীর জল বাড়তে শুরু করে। কটেজের বারান্দা থেকে নদীর দূরত্ব হাত দশেক নীচে। নদী আর কটেজের মাঝের ঢালে বাঁশের খুঁটির উপর খড়ের ছাউনি দেওয়া বর্ধিত বারান্দায় বসে, অন্ধকারের চাদরের নীচে নিজেকে হারিয়ে ফেলার আনন্দই আলাদা। ছোট্ট টেবিল,বেতের চেয়ার আর হাতে ধরা সাদা চায়ের কাপ। বাঁশের ঝোপ থেকে উঠে আসা ঝিঁঝির ডাক আর ক্রমশ ফুলে ফেঁপে ওঠা নদীর গর্জনে মিশ্রিত এক অকৃত্রিম ঐক্যতানের আবহে হারিয়ে যাওয়ার সুখ কেবল এভাবে এখানেই উপলব্ধি করা সম্ভব। কোথা দিয়ে যেন সন্ধে পেরিয়ে নেমে আসবে রাত্রি! রাতের ডিনারটাও এখানে হলে মন্দ নয়। ছোট্ট একটা ক্যান্ডেল লাইট ডিনার! যদিও উপরে সুবিশাল বাঁশ ও খড় নির্মিত রেস্তোরাঁ আছে,তবে নদী এই বারান্দাতেই অনেক নিবিড়।


ভোরের আরেক রূপ ! চোখ খুলতেই কাচের জানালার ওপাশে ভেজা সবুজ গাছ! পাতার ফাঁকে ভেসে বেড়ায় বিচিত্র সব পাখির কলতান! সকালটা রিসর্টের পাশের রাস্তা দিয়ে অথবা নদীর পাথুরে তটে অজানা পথে খানিক হেঁটে আসার মাঝে পাওয়া যায় আবিষ্কারের আনন্দ! খুব প্রয়োজনে কাছেই আছে জোরথাং বাজার। পিপলে মোড় পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে বড় রাস্তা থেকে শেয়ারের ট্রেকারে ৭ মিনিট মতো লাগবে। বাজারে পৌঁছে মনে হবে,দেশের মাটি থেকে বিদেশে এসে পড়েছেন।


দ্বিতীয় সন্ধেটা রিসর্টের সুইমিংপুলে কাটাতে মন্দ লাগবে না। পাশেই আছে বড় একটা তন্দুর। চোখের সাথে রসনারও তৃপ্তি! পুলের মৃদু আলোয় রোমান্টিক গানের সাথে ঘন গাছগাছালির নির্জনতা গায়ে মাখার স্মৃতি সারা জীবনে ভুলবার নয়! ব্যস্ত জীবন থেকে পালিয়ে জীবনে ফেরার গল্পটা লিখতে একবার অনন্ত আসতেই হবে এই নির্জনবাসে। নদীকে দিতে হবে আবার ফেরার প্রতিশ্রুতি।


অতিরিক্ত তথ্যঃ [ জোরথাং ব্রিজে প্রবেশের আগেই বাঁ-দিকে পিপলে যাওয়ার শেয়ারের গাড়ি পাওয়া যায়। নিউ জলপাইগুড়ি ফেরার জন্য জোরথাং থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর শেয়ারের ট্রেকার চলে।]


লেখিকা : রুমকি রায় দত্ত।

bottom of page