top of page

সতীপীঠস্থান মরুতীর্থ হিংলাজ


ree

পুরাণে কথিত সতীরূপী দেবী দুর্গা তাঁর পিতার গৃহে দক্ষযজ্ঞে অনাহূত হয়েই এসেছিলেন। তাঁর পতি দেবাদিদেব মহেশ্বরও ছিলেন সেই যজ্ঞানুষ্ঠানে অনাহূত। দেবাদিদেবের মত ছিলো না সতী তাঁর পিতৃগৃহে অনিমন্ত্রিত ও অনাহূত হয়ে যান। সতী পতির অমতেই গমন করেন পিতৃভবনে। তাঁর যুক্তি ছিলো, "পিতৃগৃহে যেতে কন্যার আবার নিমন্ত্রণের বা আহ্বানের কি প্রয়োজন?" সত্যই তো পিতৃগৃহে যেতে তো কন্যার আনুষ্ঠানিকভাবে নিমন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ে না! সুতরাং সতী গিয়ে পৌঁছলেন যজ্ঞানুষ্ঠানে... পিতা দক্ষপ্রজাপতির ভবনে। কত খুশির কথা হওয়ার ছিলো... রচিত হতে পারতো কতই না আবেগী আনন্দঘন মুহূর্ত! কিন্তু তাতো হলোই না। হয়তোবা নিয়তির নির্মম পরিহাস, কিম্বা ভবিতব্য, অথবা লীলা... কেবলই দেবলীলা ও দেবীমাহাত্ম্য!


কন্যা সতী পিতৃগৃহে পা দেওয়া মাত্র পিতার উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়া তো দূর অস্ত... পিতা দক্ষপ্রজাপতি প্রবলভাবে সর্বসমক্ষে যজ্ঞানুষ্ঠানে বসেই আরম্ভ করলেন জামাতা দেবাদিদেব মহাদেবের চরম নিন্দা। সতী অনুরোধ করেন পিতাকে অমনভাবে কটুকাটব্য করে অশিষ্ট ভাষায় দেবাদিদেবের নিন্দামন্দ করতে। বিফল সতীর অনুরোধ। পিতা দক্ষপ্রজাপতি আরো উল্লসিত ভঙ্গিতে নির্মমভাবে দেবাদিদেবের নিন্দা করেই চলেন। সর্বসমক্ষে স্বামীর এরূপ অপমান সহ্য করতে পারেন না সতী। দক্ষযজ্ঞস্থলেই দেহত্যাগ করেন। সতী আর নেই... সংবাদটি গিয়ে পৌঁছায় দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন মহাদেব। দক্ষযজ্ঞস্থলে পৌঁছে তাণ্ডবলীলা আরম্ভ করেন সতীর নিষ্প্রাণ দেহ কাঁধে নিয়ে। ত্রিভুবন কম্পিত, লয় হয় বুঝি স্বর্গ মর্ত্য পাতাল, রসাতলে যায় বুঝি সৃষ্টি। ভগবান বিষ্ণু সৃষ্টিকে রক্ষার উদ্দেশ্যে দেবাদিদেব মহেশ্বরের এই রদ্র তাণ্ডবলীলা থামানোর আর কোনো পথ খুঁজে পেলেন না... সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর নিষ্প্রাণ দেহকে খণ্ড-বিখণ্ড করে দিলেন। সতীদেহ একান্নটি অংশে খণ্ডিত হয়ে ধরিত্রীর বুকে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লো। সতীর দেহাংশ বক্ষে ধারণ করে ধরিত্রীর একেকটি স্থান পরিচিত হলো সতীপীঠ নামে। একান্নটি স্থান পেলো পীঠস্থানের মাহাত্ম্য... পরম পুণ্যতীর্থের মর্যাদা পেলো। একান্ন সতীপীঠের নামকরণও হলো। দেবীমাহাত্ম্য প্রচারিত ও প্রসারিত হলো ভক্তদের মনে ও জীবনে।


বর্তমান পাকিস্তানে আছে এমনই এক সতীপীঠ... হিংলাজ তীর্থ, অর্থাৎ মরুতীর্থ হিংলাজ। দেবী মাতা পূজিতা এখানে হিংলাজ দেবী নামে। হিন্দু পুরাণ মতে সতীর খণ্ডিত দেহ থেকে ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিলো এখানে। জাগ্রত হিন্দু দেবীর ও তাঁর মন্দিরের

নামেই সংলগ্ন গ্রামটির নামও হিংলাজ৷ বাংলা, হিন্দি, অসমীয়া ও সিন্ধি ভাষায় দেবীর নাম হিংলাজ হলেও মূল সংস্কৃত শব্দটি হলো "হিঙ্গুলা"৷ সেকালে হিংলাজ তীর্থের যাত্রীরা যেতেন উটের পিঠে চড়ে৷ যাত্রা শুরু হতো পাকিস্তানের করাচি শহরের কাছে হাব নদীর ধার থেকে৷ যাত্রীদের সঙ্গে নিতে হতো এক মাসের রসদ... যেমন শুকনো খাবারদাবার, মরুদস্যুদের প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র, পানীয় জল, অতিরিক্ত কিছু পোশাকআশাক ইত্যাদি৷ এছাড়া তীর্থযাত্রীরা সঙ্গে নিতেন হিংলাজ মাতার প্রসাদের জন্য শুকনো নারকেল, মিছরি, বাতাসা, শুকনো ফল৷ এক মাসের অত্যন্ত কঠোর দীর্ঘ যাত্রার পর শ্রান্ত তীর্থযাত্রীরা পৌঁছতে পারতেন হিংলাজে৷ অঘোর বা হিঙ্গুল নদীতে পুণ্যস্নান সেরে তীর্থযাত্রীরা দর্শন করতে যেতেন হিংলাজ মাতাকে৷


হিংলাজ মাতার মন্দির স্থানীয় বালুচ সম্প্রদায়ের মুসলমানদের কাছেও পরম আদরণীয়৷ তাদের কাছে এই তীর্থযাত্রা "নানী কী হজ" নামে পরিচিত৷ সেকালে হিংলাজ তীর্থের মন্দিরটি একটি গুহার মধ্যে অবস্থিত ছিলো৷ এটি মূলতঃ একটি অগ্নিকুণ্ড৷ এই অগ্নিজ্যোতিকেই হিংলাজদেবীর রূপ বলে জানা যায় ও মানা হয়। বিখ্যাত বাঙালী ঔপন্যাসিক কালিকানন্দ অবধূত রচিত "মরুতীর্থ হিংলাজ" এবং "হিংলাজের পরে" উপন্যাস দুটিতে হিংলাজ ও কোটেশ্বর তীর্থদ্বয়ের বিস্তৃত ও অনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। বই দুইটি যে কেবল মরুতীর্থ সতীপীঠ হিংলাজে গমনাগমনের কাহিনী তাই নয়, আসলে বই দুটি একজন সংসারবিরাগী মানুষের জীবনদর্শনের লিখিত রূপও বটে। মনোহারী ভাষা সমৃদ্ধ চমৎকার গদ্য সম্বলিত বইদুটির সাহিত্যমূল্যও অনেক উচ্চস্থানীয়। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে শ্রী দুলালচন্দ্র সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন এবং উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে গিয়ে অবধূত হন। তার নতুন নামকরণ হয়... কালিকানন্দ অবধূত। অবধূত কথাটির ব্যাখ্যা হলো একরূপ সাধক। তাঁর হিংলাজ যাত্রা শুরু হয় বাংলা ১৩৫৩ সনের আষাঢ় মাসে। তারপর রচিত হয় তাঁর মহামূল্যবান অভিজ্ঞতার দলিল স্বরূপ উক্ত উপন্যাস দুইটি।


হিংলাজ মাতার মন্দির সংলগ্ন স্থানীয় বালুচ সম্প্রদায়ের মুসলমানদের কাছেও পরম আদরণীয়া দেবী হিংলাজ মাতা। সে দেশের মানুষ তাঁকে ডাকে "বিবি নানী" বলে। করাচির ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, আরব সাগর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে, এবং সিন্ধু নদ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অঘোর বা হিঙ্গুল নদীর তীর। বালুচিস্তান প্রদেশের লাসবেলা জেলার হিঙ্গুল ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে হিঙ্গুল নদী। এই নদীর তীরেই একটি দুর্গম পর্বতগুহায় বিরাজ করছেন বালুচিস্তানের জগৎবিখ্যাত "বিবি নানী"। তিনিই আবার হিন্দুদের একান্নটি শক্তিপীঠের শ্রেষ্ঠ পীঠের অধিশ্বরী দেবী মাতা... হিংলাজ দেবী। এই পীঠস্থানকেই আমরা চিনি "মরুতীর্থ হিংলাজ" নামে। সমগ্র পাকিস্তানের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা চেনেন "নানী কি মন্দির" নামে। সারা বিশ্বে এই দেবীর তুলনা নেই আর। কথিত ও বিশ্বাস যে এই দেবী মাতাই পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের সম্পূর্ণ সুরক্ষা প্রদান করেন। তাই বিশেষ এই হিন্দুদেবীকে ভক্তিভরে পূজা করেন বালুচ মুসলমানরাও। তাঁরা নিজেদের সাংসারিক পারিবারিক সুরক্ষা ও মঙ্গল কামনায় হিংলাজ দেবী মাতার দরবারে আসেন।


পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে প্রচুর হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও, এই জাগ্রতা হিন্দু দেবী হিংলাজ মাতার মন্দিরের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

হিন্দু পুরাণ মতে, এই স্থানে সতী দেহের খণ্ডনকালে সতীর ব্রহ্মরন্ধ্রটি পড়েছিলো। তাই দেবীকে এখানে "কোট্টারী" এবং তাঁর ভৈরবকে "ভীমলোচন" রূপে পূজা করা হয়। শিবসরিতা মতানুসারে হিংলাজ পীঠস্থানটি হল একান্ন পীঠের প্রথম পীঠ। কুলার্ণব তন্ত্র মতানুসারে আঠারোটি পীঠের তৃতীয় পীঠ। কুব্জিকা তন্ত্র মতানুসারে বিয়াল্লিশটি সিদ্ধপীঠের পঞ্চম পীঠ। তবে অবশ্যই হিংলাজ মাতার পীঠটি হিন্দুশাস্ত্রের সব পুস্তকেই অতিজাগ্রত শক্তিপীঠ হিসেবেই বর্ণিত। "হিংলাজ মাতা" ও "বিবি নানী" বাদেও আরো অনেক নাম প্রচলিত আছে এই দেবীর... যেমন কোট্টারী, কোট্টভি, কোট্টরিশা।


এপ্রিল মাসে করাচি থেকে "নানী কি হজ" যাত্রা শুরু হয়। হিংলাজ মাতার দরবারে তীর্থযাত্রীরা আসেন ভারত, পাকিস্তান ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। এখন অবশ্য অনেক সুগম হয়েছে মরুতীর্থ হিংলাজ যাত্রা। করাচি থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার পথ গাড়িতে করে পার হয়ে, মরুভুমির দুর্গমতম স্থানে অবস্থিত "হিংলাজ মাতা" অর্থাৎ "নানী কি মন্দিরে" আসেন হিন্দু ও মুসলমান ভক্তরা। পাহাড়ের গুহার মধ্যে বিরাজমান "মাতা হিংলাজ" বলে পূজিতা হন ঐ গুহার মধ্যে থাকা সিঁদুরলেপা পাথরখণ্ডটিই। তিনিই হলেন হিন্দুদের আদরণীয়া "হিংলাজ মাতা" এবং বালুচ অধিবাসীদের আদরণীয়া "বিবি নানী"। আর পাহাড়ের ঐ গুহাটিই হলো "হিংলাজ মাতার মন্দির" বা "নানী কি মন্দির"... যাই বলা হোক না কেন। ঐ গুহা মন্দিরের ভেতরে আবহমান কাল ধরে জ্বলছে একটি প্রাকৃতিক গ্যাসের অগ্নিকুণ্ড। এই জ্যোতির্ময়ী অগ্নিশিখাকেই হিংলাজ দেবীর অপর রূপ বলে মান্যতা দেওয়া হয়। গুহা মন্দিরের কাছেই আছে একটি কুণ্ড... বিজ্ঞান মতে এটি প্রাকৃতিক মাড ভলক্যানো। কুণ্ডের মধ্যে অবিরাম ফুটে চলেছে কাদা মাটি। কিংবদন্তী প্রচারিত যে এই উত্তপ্ত ফুটন্ত কুণ্ডের সামনে এসে অন্তরের মধ্য থেকে দেবীকে স্মরণ করলে সর্বপাপ স্খালন হয়। হিন্দু ভক্তরা অর্ঘ্যরূপে দেবীকে দেন ফুল ও নারকেল এবং মুসলমান ভক্তরা অর্ঘ্যরূপে দেবীকে দেন শিরনি ও খেঁজুর।


"হিংলাজ মাতা" বা "বিবি নানী"র গুণগান পঞ্চমুখে করেন সর্বধর্মের তীর্থযাত্রীগণ। সকল মনস্কামনা পূরণ করেন যে তিনি। নানীর মন্দির বুক দিয়ে আগলে রাখেন স্থানীয় বালুচ মুসলমানরা। নানী মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে, তীর্থযাত্রার পুরোটাই তদারকিও করেন তাঁরাই। তাঁদের মনে অধিষ্ঠিত সরল ও চিরাচরিত পরম বিশ্বাস যে... হিংলাজ মাতা বা বিবি নানী... যে নামেই তাঁকে ডাকা হোক কেন, তিনি আসলে তাঁদের পরিবারেরই একজন, তিনি বালুচিস্তানের আত্মার আত্মীয়। বালুচিস্তানের জনজীবনে তাঁর পূর্ণ অস্তিত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে তিনি বিরাজমানা। এমন অপরূপ মেলবন্ধন ভক্তি ও ভালোবাসার যে কেবলমাত্র শক্তিপীঠ বা সতীপীঠ মরুতীর্থ হিংলাজেই দৃশ্যমান ও অনুভূত! জয় দেবী মাতা হিংলাজ দেবীকি জয়, জয় বিবি নানীকি জয়, জয় মরুতীর্থ হিংলাজকি জয়।


আমি চলেছি আমার এই স্বপ্নের যাত্রায়... মরুতীর্থ হিংলাজে আজ আমার মানসভ্রমণ। আর আশা বা দুরাশা... কখনো যদি সাকারপ্রাপ্তি ঘটে এই স্বপ্নের, সেই মহাতীর্থের যাত্রাপথে উদাত্ত কন্ঠে গাইবো সেই গান, "দূর, আর কতদূর, বলো মা...!"


তথ্যসূত্র: গুগল, ইন্টারনেট সার্চ, উইকিপিডিয়া।


চিত্রঋণ: ইন্টারনেট ফ্রি সাইট ।


কলমে - সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী ।

 
 
 

Comments


bottom of page