top of page

হে নারী


ree

আজ একটু অন্যরকম করে গল্প বলি কেমন?

আমরা যে দেশটাতে বাস করি সেই দেশটার অর্থাৎ ভারতবর্ষের বেশীরভাগ অংশেই নারীদের অবস্থান বড্ড নড়বড়ে। আজও নারী যেন সঠিকভাবে খুঁজে পেয়ে উঠতে পারে নি নিজের স্থান.... নিজের প্রকৃত অবস্থান। সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারী চূড়ান্ত সফল তার কর্মক্ষেত্রে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি এবং জানা অজানা বহু ক্ষেত্রেই নারী অগ্রগণ্যা পুরুষকে পিছনে ফেলে। তবুও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নারী সমাজের সংসারের ক্ষেত্র বিশেষে অবলা অসহায় হতে বাধ্য হয়।



ree

আজও কন্যাভ্রূণ হত্যা হয়, নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, ধর্ষিতা হয়, লাঞ্ছিতা হয় নিজের পরিবারের হাতে। সরকারী ব্যবস্থাপনায় নারী সুরক্ষায় আছে বিভিন্ন প্রকল্প। উপকৃত বহু কন্যাসন্তান "বেটি বাচাও বেটি পড়াও", "কন্যাশ্রী" প্রকল্পের মাধ্যমে বা "নারী অধিকার সুরক্ষা কমিশনের" দ্বারা। তবুও, হ্যাঁ তবুও বলি, আমার এই হতভাগ্য দেশের প্রতিটি নারী..... কন্যা, ভগ্নী, মাতা, সখী বা বান্ধবী সবাই সুরক্ষিত নয়, এটি অত্যন্ত কঠিন বাস্তবতা। দেশের সম্পূর্ণ জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হবার কথা, কিন্তু প্রতিদিন নারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমছে আমাদের দেশে।



ভারতে স্ত্রী-পুরুষের আনুপাতিক হারে পুরুষের সংখ্যা মহিলাদের চেয়ে বেশি৷ প্রতি এক হাজার পুরুষ পিছু মহিলা সংখ্যা – ৯১৪ (প্রতি 1000 পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা 914 মাত্র) স্বাধীনতার পর এই ব্যবধান সবচেয়ে বেশি৷ ২০১১ সালের আদমশুমারির প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ করে সেন্সাস কমিশনার সি.চন্দ্রমৌলি বলেন, এটা উদ্বেগের বিষয়৷ উল্লেখ্য, ভারতের কিছু কিছু রাজ্যে কন্যাভ্রুণ হত্যার হার বেশি৷ কন্যাকে আর্থিক বোঝা বলে মনে করা হয়৷ পরবর্তী আদমশুমারি (সেন্সাস বা জনগণনা) ২০২১এর রিপোর্টে হয়তো নারীর সংখ্যা আরো ভয়ঙ্কর ভাবে কমবে।


ree


এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ নারীকেই খুঁজতে হবে। এখন আমি ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটি ঘটনায় দেখাবো নারীরাই কিভাবে নারীদের অসম্মান করে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। এমনকি নারীরাই নারীদের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায় কার্যতঃ প্রতি পদে পদে অকারণে নারীদেরই ত্রুটি খুঁজে খুঁত ধরে ধরে।


***


আমাদের দেশের সমাজে নারীদের অবস্থান ঠিক কোথায় কেমন, বিভিন্ন ভাবে তাদের বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা এবং নিরাপত্তাহীনতা কতদূর  তা এবার দেখা যাক ঘটনাগুলিতে:-


(১) সমাপ্তি


------------------


তিন মেয়ের মা নমিতার কোলে আবার মেয়ে দেখে নমিতার শাশুড়ি মুখ বেঁকিয়ে বললে, "মরণদশা"! আর মুখেমুখে নমিতার ছোটমেয়ের নাম "মরণি" হয়ে গেলো।


ইস্কুলে ভর্তির সময় নমিতার স্বামী ভবেশ মেয়ের নাম লেখালে "সমাপ্তি"। বীথি, প্রীতি, স্মৃতির বোন সমাপ্তি।


নমিতার শাশুড়ি গত, বড়-মেজো-সেজো মেয়েও ভালো বরে-ঘরে আর ছোটমেয়ে বংশে প্রথম ইস্কুলের গন্ডী টপকে কলেজে।


দিন-মাস-বছর গড়ায়...... বড্ড সুখী নমিতা.... ছোটমেয়ে সমাপ্তি অনেক বড় চাকরি পেয়েছে যে।


প্রথম মাসের মাইনেয় অনেক কেনাকাটি করে বাড়ী ফেরার পথে এক তেলের ট্যাঙ্কার সমাপ্তির জীবনটা কেড়ে নিলো, সমাপ্তির জীবনের সমাপ্তি ঘটলো।


আবার পাড়া-প্রতিবেশীর গুঞ্জন...... "এমন নাম কেউ রাখে?"

--------------


(২) আপদ

----------------


অপটু নতুন-বৌ বিনতার হাত থেকে গরম ঘি-ভাত ভর্তি ভারী গামলাটা ঝনাৎ শব্দে মেঝেয় পড়লো।  বিনতা অধোমুখী, তুতো শাশুড়িদের বাক্যবাণের সাথে বাড়তি পাওনা... নিজের  শাশুড়ি যখন "আপদ কোথাকার" বলে নড়া ধরে ঘরে ঢুকিয়ে দিলো।


এখন বিনতা নিজেই শাশুড়ি আর তার শাশুড়ি শয্যাশায়ী.... মুমুর্ষু।


বিনতার ছেলেরবৌ টুপুরের ঠাকুমাশাশুড়ির দক্ষিণের বিশাল ঘরটা ভারী পছন্দ , কিন্তু বিনতা টুপুরের পছন্দে সামিল নয়।


বিনতা শাশুড়ির গা মোছাচ্ছে আর তিনি 'আঁআঁ' করছেন। টুপুর ঐঘরেরই জানালার পাশ থেকে বলে উঠলো , "আপদ কোথাকার"!


জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বিনতার ঝাঁঝালো ধমক টুপুরকে। আর বিনতার অশক্ত নির্বাক জরাজীর্ণ শীর্ণ শাশুড়ির দু'চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা।

-------------


(৩) পণ

------------


শ্যামশ্রীর নামের সাযুজ্যেই তার গায়ের রঙটিও। এই নিয়ে শাশুড়ির মুখে তার গঞ্জনার শেষ নেই।


শ্যামশ্রীর পেটে যেটুকু বিদ্যে-বুদ্ধি ছিলো তার জোরেই কঠিন পরীক্ষা উৎরে ইস্কুলের মাষ্টারনীর পাকা চাকরি জোগাড় হয়েছিলো। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত

বঙ্গ-সমাজে সারাজীবন আইবুড়ো থাকার ছাড়পত্র জোটানো মুশকিল।


অতঃপর কালোমেয়ের পাল্টিঘর ব্যবসায়ী বর জোটাতে বাবার ভিটেমাটি চাঁটি হোলো। লাখপাঁচেক খসিয়ে তবে কালোমেয়ে পাত্রস্থ। অবিশ্যি শ্যামার বরের ব্যবসাটি চাক্ষুষ না করেই।


এতকাল শ্যামার শাশুড়িই একতরফা বকবকিয়েছে। আজ শ্যামার গলায়, " এইযে শাশুড়িমা, আমার গায়ের কালো ঢাকতে বাবা পাঁচলাখ দিয়েছিলো। তা বাবাকে আপনি ক'লাখ দিচ্ছেন আপনার ছেলের চরিত্রের কালো ঢাকতে?"


নারীপাচার কান্ডে ধরা পড়ে সেদিনই শ্যামার বর অ্যারেস্ট হয়েছে।

------------------


(৪) ভাইরাল

--------------------


সবকিছু নিখুঁত, একদম পারফেক্ট ভিডিও, ঠিক যেমনটি চেয়েছিলো অনিকেত। মনটা বেশ ফুরফুরে, অনিকেত একটা সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির আড়মোড়া ভেঙ্গে বড় সোফাটার নরম গদিতে শরীর ডোবালো।


মনেমনে হিসেবনিকেশ করে নিলো পরিচালক অনিকেত মিত্র..... মিডনাইটেই ভিডিওটা সাইটে আপলোড করবে।


শম্পা তখনো অঘোরে ঘুমিয়ে, জাগলেই ওরা ডিনার করবে। হানিমুন ট্রিপটা দারুন চলছে!


ডোরবেল বাজছে, রুমসার্ভিস হয়তো। দরজা খুলে অনিকেত চোখ কচলালো, রিয়া? রিয়া তো রিহ্যাব সেন্টারেই গলায় দড়ি দিয়েছিলো.....


পরদিন ছোট্ট খবর.....মানালির হোটেলে হানিমুনে আসা নবদম্পতির স্বামীটির রহস্যজনক মৃত্যু। ভদ্রলোকের ক্যামেরা ও ল্যাপটপ থেকে উদ্ধার হয়েছে অগণিত ব্লু ফিল্মের ভিডিও। তারমধ্যে সর্বশেষটি নববিবাহিতা দ্বিতীয়া স্ত্রী শম্পাকে নিয়ে।

----------------------------


(৫) মাঝ রাতের টুকরো কথা

-----------------------------------------



শেফালিমাসী পানের পিকটা পিকদানে ফেলে গুনে গুনে টাকাটা নিয়ে ব্লাউজের ভেতর চালান করে দিয়ে গলা তুলে ডাকলো, "বিন্দি, ও বিন্দি .... একবার ইদিকে আয় দিকি।"


ষোলো বছরের বিন্দি জড়সড় হয়ে এসে মুখ নীচু করে  দাঁড়ালো।


শেফালিমাসী ছাপ্পান্ন বসন্ত পার করা বসন্তর দিকে ফিরে চোখ মটকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, "আসেন গো বাবু, আসেন....."


"যা লো বিন্দি, ঘরে নে যা বাবুকে......"


"কয় গো বাবু, যান...যান দিকি ঘরে, দেক্কে নেবেন, এক্কেবারে আনকোরা নতুন মাল, আপনার পচ্চন্দসই! এই শেফালি কক্কোনো মিচে কতা কয় না....."


বাইরে অঝোরে ঝরছে ইলশেগুঁড়ি।

এফএমে কোথাও বাজছে, ".....রঙ্গ বরষে....."


****


পাঁচটি, হ্যাঁ মাত্র পাঁচটি! পাঁচটি মাত্র বিক্ষিপ্ত ঘটনা থেকেই কিছুটা দেখতে পাচ্ছি আমরা আমাদের দেশের মেয়েদের, আমাদের প্রিয় সহনাগরিকদের সামাজিক ও স্থানিক অবস্থান। সামান্য পরিসরে তো আর এর থেকে বেশী দেখানো একবারে সম্ভব নয়। তবে ঠিক এরকম ভাবেই দেশের প্রতিটি কোণে কোণে ছড়িয়ে আছে নারীর অজস্র অবমাননার, অবমূল্যায়নের, অবহেলার কাহিনী।


"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/কেন নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা?" প্রশ্নটা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলেছিলেন 'মহুয়া' কাব্যের 'সবলা' কবিতায়। তারপর কেটে গেছে বহুকাল। নারী এখন নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে নিচ্ছে, নিজেদের সুশিক্ষিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা অর্জন করছে। 'সময় এখন নারীর, উন্নয়নে তারা, বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরে কর্ম জীবনধারা'। কর্ম ও জীবনধারা বদলে দিয়ে নারী সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবদান রাখলেও নিজেরা এখনও হচ্ছে নিগৃহীত। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই, পারিবারিক ও গার্হস্থ্য সহিংস আক্রমণের লক্ষ্য ও শিকার হচ্ছে সমগ্র দেশ জুড়েই নারীদের একটা বড় অংশ। 



শুধুমাত্র সরকারী প্রকল্প আর আইনের হাত ধরেই কিন্তু এই পরিস্থিতির পরিবর্তন অসম্ভব। একমাত্র এই পরিস্থিতির সার্বিক পরিবর্তন তখনই সম্ভব হবে যখন সমাজের প্রত্যেক নারী সজাগ হবে, সচেতন হবে, সতর্ক হবে নিজের সম্পর্কে এবং তার চারপাশের প্রতিটি নারী সম্পর্কে। শিক্ষার বিস্তার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির দাবি নয় দায়িত্ব যেদিন নারী নিজের হাতে তুলে নেবে, পাশের অসহায় নারীটির স্বাধিকার রক্ষায় সোচ্চার হবে, সেদিন পরিবর্তন আসবে আমাদের দেশের আম-নারীদের জীবনেও। সব আবেগ, দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার ঊর্দ্ধে উঠে আহ্বান করি....."হে নারী, জাগো.......!"

বিশ্বকবির লেখনীতে স্মরণ করি বার বার বারংবার,

"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা?"


--------------------------------------------


কলমে - সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী

 
 
 

Comments


bottom of page