top of page

মগ্ন কবি, ধূসর যাপন


( দ্বিতীয় পর্ব)


#১

স্বপ্নময় সকাল জুড়ে শুধু জল ফড়িংয়ের লাফালাফি। পিউপা থেকে পাখনা মেলতেই যা দেরী। দেখতে দেখতে উড়ে আসে দিন। রাকার প্রথম কবিতার বই। রাকার স্বপ্ন উড়ানের প্রথম নিশান। রাকার চোখ অপেক্ষমান একটা মাত্র গেরুয়া পাঞ্জাবীর জন্য। ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড বয়ে চলে যায় উজানি নদীর স্রোতে। কথা ভেসে যায়। হাজার আলোর রোশনাই ম্লান হয়ে আসে। উজ্জ্বল হলুদ ঢাকাই জামদানিতেও রাকাকে বড় বিবর্ণ, ম্লান মনে হয়। সে আসবে বলেও আসে না। ফোনের ওপারে অপার নিস্তব্ধতা। রোবোটিক চলনে নিজের বই হাতে নেয় রাকা।

----- হিমাদ্রি আজ চ্যানেল ফাইভে গেস্ট। তাই মনে হয় আসে নি না?

-----কই? হিম তো নিজের মুখে একবারও জানালো না? মনে মনে ব্যথা পায় সে। সমস্ত আনন্দ নিমেষে হারিয়ে যায় ইথারে ইথারে।

যন্ত্র মানুষের মতো সমস্ত অনুষ্ঠান সামলায় সে। মুখে কৃত্রিম হাসি। বুকের ভিতর অনন্ত সাইক্লোন।

কত সহজে সব কিছু ভুলে থাকা যায়, কত সহজে এক ভালোবাসাকে আরেক ভালোবাসায় পরিণত করা যায় এমনটা জানে না সে।

ঘরে ফিরে আরও একবার মোবাইলে আঙুল রাখে। ওপারে অসীম নিস্তব্ধতা। মেসেজগুলো যথারীতি আনরিড। একটা একটা করে জমানো আলজলামের পাতা থেকে ওষুধ বার করতে থাকে সে। সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবার দাওয়াই। চলে যাবে সে। এই পৃথিবীতে তার কোন দাম নেই আর। ভালোবাসা ফাঁসের মতন তার গলায় চেপে বসেছে। হয়তো হিমের গলাতেও বসেছিল। তাই সে ফাঁস কেটে পালিয়েছে।

সংক্রামক অসুখের মতো

ছড়িয়ে পড়ছ

দুচোখে রক্তজবা

সমস্ত পাঁজরে আগুনে উত্তাপ

বুকের ভিতর চাপ চাপ ব্যথা

মৃত্যু উপত্যকা পার হতে গিয়ে

নিজেকে হারিয়ে ফেলছি,

তাই মুক্তি দিলাম

সমস্ত সংক্রমণ থাক

আমারই, আমারই, আমারই।


#২


রাকা সেনকে যেদিন নার্সিং হোমে আনা হলো ড: অগ্নিময় চ্যাটার্জির তখন ডিউটি শেষ। তবু একবার কাছ থেকে দেখার জন্য থেকেই গেল সে। রাকার কবিতা অগ্নি ভালোবাসে, পছন্দ করে। সিনেমায়, ব্যান্ডে রাকার কবিতায় সুর দেওয়া হয়। রাকা শুধু একজন কবি নয়, সে একজন আইকনও বটে। যুব সমাজের কাছে একটা উন্মাদনা। তার প্রিয় বিষয় কিন্তু আলো নয়, অন্ধকার। তার প্রিয় বিষয় বিষণ্নতা। বিষণ্নতার মাদকে সে নেশাচ্ছন্ন করে রেখেছে যুব সমাজকে।

এর আগেও প্রায় পাঁচবার সুইসাইডাল আটেম্পট নিয়েছে সে। প্রতিবারই ব্যর্থ। প্রতিবার ফিরেই নতুন নতুন সফল কাব্যগ্রন্থের জন্ম দিয়েছে সে। আজকের ডিজিটাল বাজারে তার কবিতার বই হট কেকের মতো বিকিয়েছে।

অথচ চরিত্রের একটা গ্রে শেড তার পিছু ছাড়ে না। সে ড্রাগস নেওয়ার জন্য মাস খানেক জেল খেটেছে। সন্ধ্যের পর থেকে অন্ধকার ছাড়া আর কেউ কোনদিন তার মুখ দেখেছে কিনা জানা নেই। সম্প্রতি নায়ক দীপ কুমারের সঙ্গে একটু বেশীই দেখা যাচ্ছিল তাকে। সাংবাদিক পেটানোতে তার জুড়ি মেলা ভার। এহেন বিরল প্রজাতির কবিকে একবার চোখে দেখতেই হয়।

বাইরে সাংবাদিক আর যুবক ফ্যানেদের ভীড়। ও. টি. তে গিয়ে এপ্রণ আর গ্লাভস পরে নিল অগ্নি। বিষ মনে হয় বিষকন্যার সহ্য হয়ে গেছে। তবুও কিছু থেকে যায়। সেগুলো ওয়াশ করে বের করে দিতে হবে শীঘ্রই।


নাথিং টু বি ওরিড।


নিজেই নিজেকে বললো অগ্নি।


তখন অনেক রাত। আকাশে শ্রাবণ পূর্ণিমা। মেঘে ঢাকা আকাশে জ্যোৎস্না পথ হারিয়েছে। কেবিনে রাকার বেডের পাশেই বিশাল জানলা। দুহাতে পর্দা সরিয়ে দিল অগ্নি। অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলো।

রাকার জিন্সের পকেটে মোড়ানো কাগজ অগ্নির হাতে। আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা-


ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি আমরা

পারস্পরিক রেললাইনের সমান্তরালে

বিচ্ছিন্ন দুটিপদ শীর্ণ অঞ্জলীপুট

বল্কলে সরীসৃপের ধূর্ত চলন

ছোবলে ছোবলে বিষাক্ত

আমি আজ বিষকন্যা

নিঃশ্বাসে মরুভূমির ত্রাস

ক্যাকটাস শিকড় পেরিয়েছে

আদিম ভূস্তর

তোমাকে চাওয়ার অপরাধে

আমি আজ জীবন্ত কবর।


(চলবে)


কলমে - পৌলোমীমুখার্জী

 
 
 

Comments


bottom of page