কালিকা পুরাণের ইতিহাস
- dbwebdesk
- Nov 14, 2020
- 4 min read

কালিকা পুরাণ আসলে একটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। অষ্টাদশ উপপুরাণের অন্যতম। কালিকা পুরাণে সর্বমোট ৯৮টি অধ্যায় ও ৯০০০ শ্লোক রয়েছে। এতে দেবী কালী ও তাঁর কয়েকটি বিশেষ রূপবর্ণনা করা হয়েছে। দেবী কালীর বর্ণনার উদ্দেশ্যে রচিত একমাত্র গ্রন্থ হলো কালিকা পুরাণ। কালিকা পুরাণে বর্ণিত দেবী কালীর রূপগুলি হলো গিরিজা, ভদ্রকালী এবং মহামায়া। কালিকা পুরাণেই কামরূপ তীর্থ ক্ষেত্রের পাহাড়-পর্বত এবং নদ-নদী এবং দেবী কামাখ্যার মন্দিরের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এমনকি কালী, কামাখ্যা ও দুর্গা সহ বিভিন্ন দেবীর পূজাপদ্ধতিও কালিকা পুরাণে লেখা আছে। সুতরাং সেই কারণেই কালিকা পুরাণ হিন্দুধর্মের শাক্ত শাখার প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ হিসাবে গৃহীত। সম্ভবত এই গ্রন্থ কামরূপ অর্থাৎ বর্তমান অসম দেশে অথবা আমাদের এই বঙ্গদেশেই রচিত হয়েছিলো। কালিকা পুরাণ সর্বার্থেই একটি গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রগ্রন্থ। বর্তমানে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের স্মার্ত নিবন্ধ রচনাকারেরা কালিকা পুরাণকে শাক্তধর্মের অন্যতম প্রধান একটি ধর্মগ্রন্থ বলেই চিহ্নিতকরণ করেছেন।পূর্বপ্রচলিত অনেকগুলি পৌরাণিক উপাখ্যানেরও উল্লেখ আছে কালিকা পুরাণে। কালিকা পুরাণ সমস্ত বিরলতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মধ্যে এমন একটি গ্রন্থ যেখানে "হিন্দু" এই শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
আমাদের হিন্দুধর্মের প্রচলিত পুরাণের কাহিনীগুলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে বিদ্যমান অগণিত উপপুরাণ কাহিনী বিদ্যমান। তেমনই একটি উপপুরাণ হলো যে কালিকা পুরাণ তা আগেই বলা হয়েছে। কালিকা পুরাণ অনুসারে নরকাসুর অর্থাৎ নরক রাজা মিথিলা ক্ষেত্র থেকে এসেছিলো এবং অন্তিম কিরাত রাজা ঘটকাসুরকে হত্যা করে প্রাগজ্যোতিষপুরের স্থাপনা করেছিল। পুরাণে উল্লেখিত এই প্রাগজ্যোতিষপুরই হলো কামরূপ। কামরূপের শাসক বলে অভিহিত তিনটি প্রাচীন রাজবংশকে নরকাসুর বা নরকের রাজার বংশধর বলেই মান্যতা দেওয়া হয়। এই কথাগুলি শুনতে অদ্ভুত লাগলেও কামরূপের তথা অসমের ইতিহাসে এবং পুরাণের ইতিহাসে নরকাসুরের উপস্থিতির গুরুত্ব বিশাল। নরকাসুরকে হিরণ্যাক্ষের পুত্র বলে কয়েকটি সন্দর্ভে উল্লেখ করা হলেও, সেই মতবাদের স্বপক্ষে উল্লেখযোগ্য প্রমাণের অভাব প্রকট।

পুরাণে উল্লেখ যে নরক জন্ম থেকেই দুষ্ট প্রকৃতির ছিলো না। বাণাসুর নামক প্রবল অসুর ভাবাপন্ন এক অসুরের সঙ্গদোষেই নরক আসুরিক প্রবৃত্তিপুষ্ট হয় এবং তার নাম হয় নরকাসুর। নরকাসুরের মাতা ছিলেন ভূদেবী। পিতার পরিচয় স্পষ্ট করে না পাওয়া গেলেও, মাতার পরিচয় স্পষ্টতই পাওয়া গেছে। এর কারণস্বরূপ ধরা যেতে পারে যে তৎকালীন সমাজে মাতৃতান্ত্রিকতা প্রবল ক্ষমতাশালী ছিলো। অথবা সেই সময়ে সত্তা শোষণের দ্যোতক বলতে কোনো নিয়মের অস্তিত্ব ছিলো না। সমাজে সত্তা পুরুষের নাকি নারীর সেই বিষয়ে ভাবনা হয়তো তৎকালীন সমাজে গৌণ ছিলো। অবশ্য নরকাসুরের অস্তিত্বের এই কিংবদন্তির ফলে পরবর্তীকালের সমাজে পুরুষের লাম্পট্যের প্রভাব প্রবলতর হয়ে উঠেছিলো। এই বিষয়ে অসমে একটি অদ্ভুত লোকগাথাও প্রচলিত আছে। একবার নাকি নরকাসুর দেবী কামাখ্যাকে বিবাহ করার জন্য বিষম অস্থির হয়ে পড়েছিলো। দেবী কামাখ্যা আর উপায়ান্তর না পেয়ে নরকাসুরের সামনে একটি কঠিন শর্ত রাখলেন। এক রাতের মধ্যে নীলাঞ্চল পাহাড়ের নীচ থেকে উপরের মন্দির অবধি পাহাড়ের গা কেটে সিঁড়ি বা ধাপ বানিয়ে ফেলতে পারলেই একমাত্র দেবী কামাখ্যা নরকাসুরের সঙ্গে বিবাহে রাজি হবেন।
বিবাহের জন্য অধীর নরকাসুরও ক্ষণমাত্রও দেরী না করে শুভ কাজ আরম্ভ করে দিলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই দেবী কামাখ্যা বুঝতে পারলেন, নরকাসুর এক রাতের মধ্যেই পাহাড় কেটে সিঁড়ি তৈরি করে ফেলবে। দেবী তখন একটি কুক্কুট মানে মোরগকে পাঠালেন, রাত শেষ হবার আগেই কুক্কুটটি ডেকে উঠবে আর নরকাসুরও রাত শেষ হয়ে ভোর হয়ে গেছে ভেবে থেমে যাবে। যেমন দেবী কামাখ্যার ভাবনা, তেমনই কাজ হলো। কুক্কুটের ডাকে বিভ্রান্ত হয়ে নরকাসুর মাঝপথেই কাজ থামিয়ে দিলো। তারপর অবশ্য ছলনার আশ্রয়ে তাকে আটকানো হয়েছে বুঝতে পেরে নরকাসুর ক্রোধে অন্ধ হয়ে কুক্কুটটিকে হত্যা করলো। কুক্কুটটিকে যেখানে মারা হয়েছিলো বলে কথিত, সেখানটি বর্তমানে অসমের দরাং জেলায় কুক্কুড়কাতা নামে পরিচিত। আর নরকাসুরের অসমাপ্ত কাজের ফলে সেই ধাপগুলি মেখলৌজা পথ নামে পরিচিত।

মথুরার রাজা কংস নরকাসুরের মিত্রস্থানীয় ছিলেন এবং রুক্মিণীর পিত্রালয়ের বিদর্ভ রাজ্যের রাজকন্যা মায়ার সঙ্গে নরকাসুরের বিবাহ হয়েছিলো। মহাভারতের কালেও রামায়নের বালী ও সুগ্রীবের বানর রাজত্বের রাজা দ্বিবিধও নাকি নরকাসুরের মিত্র ছিল। হয়গ্রীব এবং সুন্দ নামের দুই রাক্ষসের সাহায্য নিয়ে নরকাসুর যুদ্ধে দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করে। এবং বরুণদেবের ছত্র এবং দেবমাতা অদিতির কুণ্ডলও বলপূর্বক ছিনিয়ে নেয়। বাণাসুরের প্রশ্রয়ে নরকাসুরের অত্যাচার ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। বর্তমান অসমের গৌহাটির কাছে ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রম ছিলো। নরকাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বশিষ্ঠ নরকাসুরকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। এই অভিশাপও বড় অদ্ভুত ছিলো। নরকাসুরকে তার সেনাবাহিনীসহ একমাত্র তখনই পরাজিত করা যাবে, যখন তার উপর আক্রমণকারী একজন এমন নারী হবেন, যিনি সম্পর্কে হবেন নরকাসুরের মাতা।
বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণের পত্নী সত্যভামাকে নরকাসুরের মাতা ভূদেবীর অবতার বলে মনে করা হতো। কাজেই যখন সত্যভামা নরকাসুরের যাবতীয় অপকীর্তির কথা জানতে পারলেন, তখন প্রবল ক্রুদ্ধ হয়ে সত্যভামা নরকাসুরের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মায়াকে বিবাহের সময় যে শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে রথ উপহার দিয়েছিলেন, সেই শ্রীকৃষ্ণই আবার নরকাসুরের সঙ্গে যুদ্ধকালীন সত্যভামার রথের সারথী হলেন। নরকাসুরের রাজ্য ছিল নাগলোকের অঞ্চলে। সুতরাং সত্যভামার সঙ্গে নরকাসুরের যুদ্ধে গরুড় অংশগ্রহণ করলো।
যুদ্ধে নরকাসুরের একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা নিহত হলো। নরকাসুরের সেনাপতির নাম ছিল "মুর" এবং তাকে বধ করার কারণেই কৃষ্ণের আরেক নাম হলো "মুরারি"। নরকাসুরের সঙ্গে লড়াইতে শ্রীকৃষ্ণ এবং সত্যভামা যুগলে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নরকাসুরের প্রবল এক প্রহারে শ্রীকৃষ্ণ সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন। তখন সত্যভামা একাকিনী যুদ্ধ করলেন এবং নরকাসুরের বুকে তীর মেরে তাকে বধ করলেন। তারপর সংজ্ঞা ফিরে এলে ক্রোধান্বিত শ্রীকৃষ্ণ নিজের সুদর্শন চক্র দিয়ে নরকাসুরের জিহ্বা খণ্ডিত করে দিয়েছিলেন।
কালীপূজা তথা দীপাবলির আগের দিনে আমাদের বাংলার সকল প্রান্তেই ভূত-চতুর্দশী পালন করা হয়ে থাকে। নরক চতুর্দশী কিন্তু বলা হয় না... বিষয়টি লক্ষণীয়। তবে অবশ্যই এখনও আমাদের দেশে নরকাসুর দহন হয়, যেমন দশেরার দিনে রাবণ দহন এবং হোলির আগে হোলিকা দহন করা হয়ে থাকে, ঠিক তেমন ভাবেই। পুরাণের ইতিহাসের গোমান্তক অর্থাৎ বর্তমান গোয়া রাজ্যে নরকাসুর দহন হয়ে থাকে আজও। ভাববার বিষয় হলো এই দুই স্থানের দূরত্ব... কোথায় গোয়া, আর কোথায় অসম! ভারতবর্ষের প্রায় দুই প্রান্তের দুটি রাজ্য... কী এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ। আজও গোয়ায় এই নরকাসুর দহন নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধির ইতিহাস এইভাবেই লোকাচারে বা লোককথায় গ্রথিত হয়ে আছে।
কালিকা পুরাণের সবচেয়ে পুরানো মুদ্রিত সংস্করণটি হলো ১৯০৭ সালে প্রকাশিত। বোম্বাই ভেঙ্কটেশ্বর প্রেস সংস্করণ এটি। এরপর ১৯০৯ সালে কলকাতার বঙ্গবাসী প্রেস থেকে কালিকা পুরাণের প্রথম মুদ্রিত বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হয়, আজ থেকে একশত এগারো বছর আগে। এই হলো অতি সংক্ষিপ্ত ভাবে কালিকা পুরাণের প্রাথমিক ইতিহাস।
-------------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া এবং মহর্ষি মার্কণ্ডেয় কথিতম্ কালিকা পুরাণম্-এর বঙ্গানুবাদ।
চিত্রঋণ: ইন্টারনেট ফ্রি সাইট
তথ্য সঙ্কলন ও অনুলিখন © সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী





Comments