যূথবদ্ধ
- dbwebdesk
- Nov 1, 2020
- 4 min read
মটমট করে ডাল ভেঙ্গে পথ করে এগিয়ে চলেছে লম্বদন্ত। ওর পেছন পেছন পুরো দলটা হেলে দুলে চলেছে বনের আরো গহীনে। ছোট বড় মাঝারি মিলিয়ে জনা পয়ত্রিশের এই দলটার সবাই লম্বদন্তকে খুব মেনে চলে। সামনেই জঙ্গলের বুক চিড়ে কুমারি মেয়ের সিঁথির মত বহুদূর চলে গেছে ধাতুর পাতের সরলরেখা দুটি। পাথর কুচি ছড়ানো ঐ পথে মাঝে মাঝেই ছুটে চলে এক অতিকায় যান্ত্রিক সরিসৃপ। ভোরের আলো সবে ফুটেছে, মদমত্ত আপন গতিতে এগিয়ে চলে। লম্বদন্ত শুড় দিয়ে ওর পথ অবরোধ করতেই ও দাঁড়িয়ে যায়।
এদলের সবচেয়ে খুদে দুই সদস্য গুরগুরি আর তুরতুরি ভীষণ চঞ্চল। ওদের মায়েরা সর্বক্ষণ ওদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। শুড় আর চারটে পা দিয়ে এক অদৃশ্য খাঁচায় ওদের ভরে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্ঠা ব্যার্থ করে ওরা বেরিয়ে আসতে চায়, দু চোখ ভরে দেখতে চায় অজানা পৃথিবীর সব রহস্য। গুরগুরি তিড়িংবিড়িং করতে করতে এগিয়ে যেতেই ওর মা আবার শুড়ে জড়িয়ে টেনে নিল ওকে নিজের পেটের নিচে।
লম্বদন্ত ঝাঁঁকড়া চালতা গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে দু দিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখে। সামনের ঝোপটার ধারে করুণ নয়নে একবার তাকায়। ওখানেই পড়েছিল ওর দীর্ঘদিনের সাথী ঔদরিকের দেহটা। যন্ত্রদানবের আঘাতে সামনের পা দুটো থেতলে গেছিল সেদিন। কিন্তু ওদের ছানাটাকে সরিয়ে দিয়ে পেরেছিল ঔদরিক। বাঁকের ওধার থেকে যখন সেই যান্ত্রিক সরিসৃপ প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছিল ঠিক তখনি চঞ্চল শিশুটা একরাশ কৌতূহল নিয়ে উঠে পড়েছিল ঐ ধাতব সরলরেখার উপর। ঔদরিক সঠিক সময় শুড়ের ধাক্কায় ওকে সরিয়ে দিলেও নিজে সরে আসতে পারেনি। এখানে এলে লম্বদন্তর কানে এখনো বাজে ঔদরিকের সেই গগন বিদারক আর্তনাদ। দূর থেকে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারেনি দলপতি লম্বদন্ত।
নীরবে কয়েকটা মুহুর্ত কাটিয়ে লম্বদন্ত আস্তে আস্তে উঠে আসে ঐ সরলরেখা দুটির উপর। মাটির কম্পন আর বাতাসের গতিপথের উপর নির্ভর করে লম্বদন্ত বোঝে সেই যন্ত্রদানবের উপস্থিতির দেরি আছে। ওর ইশারায় পেছন পেছন পুরো দলটা পার হয়ে যায়। ও আস্তে আস্তে নেমে যায় উল্টোদিকে। আরেকবার তাকায় ঘেঁটুফুলের ঝোপটার দিকে। দুটো রাত কষ্ট পেয়েছিল ঔদরিক, ওর চিৎকার যেন এখনো কানে ভাসে। সেই দুরাত ঐ বনেই অপেক্ষা করেছিল পুরোদলটা। ঘেঁটুফুলের গন্ধে যেন এখনো মিশে রয়েছে একটা চেনা গন্ধ। যুবক মদমত্ত দলটাকে নিয়ে সামনের বাঁশঝাড় পার করে এগিয়ে চলেছে। শুড় দিয়ে নরম মাটি তুলে গায়ে মাখছে দলটা, তুরতুরি আর গুরগুরিকেও মাটি মাখানো চলছে। এই বনে রয়েছে নরম কলা গাছ। শিশুদের বড় প্রিয় খাদ্য। সবাই প্রাণভরে খেতে থাকে। বনের শেষে রয়েছে সবুজ মখমলের মতো ঢেউ খেলানো চা বাগান। দূরের নীল পাহাড় থেকে ঠাণ্ডা বাতাস যখন বয়ে আসে চা বাগানের ফাঁকে বড় গাছগুলো হেলে দুলে ছায়া দেয়। পাশেই বয়ে চলেছে এক স্রোতস্বিনী। খাওয়া মিটতেই সেদিকেই চলল পুরো দলটা। জল দেখেই চঞ্চল ছানা দুটো লাফিয়ে নেমে পড়ল। শুড়ে করে জল ছিটানো ওদের প্রিয় খেলা। ওধারে কচি ধানের ক্ষেতে সোনালী রঙের ছোঁয়া লেগেছে। ভোরের প্রথম আলোয় ধানগাছগুলো মাথা নাড়িয়ে ওদের ডাকছে। পুরোদলটা বারবার দলপতির দিকে চেয়ে বুঝে নিতে চার পরবর্তী পথের দিশা। কিন্তু লম্বদন্তর সেদিকে মন নেই। দূরের নীল পাহাড় ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। একটা কালচে ধুসর চাদর যেন দ্রুত ছুটে আসছে ওদের দিকে। কি যেন এক অমঙ্গলের আশায় বুক কেঁপে ওঠে লম্বদন্তর। বাতাসের ভেজা গন্ধ যেন কি বার্তা বয়ে আনে। পিচ্ছিল পাথর পার হয়ে পুরো দলটাই নেমে পড়েছে নদীর বুকে। আর একটু পরেই ওদের বনের আড়ালে আত্মগোপন করতে হবে। মানুষ ওদের বড় শত্রু, সকাল হতেই তারা দখল নেবে এ প্রান্তরের। ধুসর চাদরটা কাছে আসতেই গুবগুব আওয়াজটা শুনতে পায় লম্বদন্ত। বিপদের আভাস পায় দ্রুত। বাকিরা জলকেলীতে মত্ত, তাই হয়তো খেয়াল করেনি। কিন্তু অভিজ্ঞ দলপতি বিপদের আঁচ পেয়েই চিৎকার করে সাবধান করে দেয় দলটাকে। বড়রা চটপট উঠে আসে। কিন্তু অবুঝ শিশুরা খেলা ফেলে উঠতে চায় না। মূর্তিমান বিভিষিকার দিকে তাকিয়ে জলে নেমে পড়ে লম্বদন্ত। তুরতুরিকে শুড়ে জড়িয়ে টেনে আনতে সক্ষম হলেও গুরগুরি আরো দূরে ছিটকে যায়। ততক্ষণে বিশাল জলস্রোত আছড়ে পড়েছে ওদের সামনে। পাহাড়ের বৃষ্টিতে এমন হরকা বান আসে এসব নদীতে। ঘোলা জলের স্রোত দুকুল প্লাবিত করে ছুটে চলেছে, সঙ্গতে তুমুল বৃষ্টি। গুড়গুড়ি সেই স্রোতের টানে ভেসে যেতে যেতেও আটকে যায় একটা বড় পাথরের খাঁজে। সেদিকে তাকিয়ে পুরো দলটা নির্বাক। নদীর জল এতটাই বেড়ে গেছে যে ধীরে ধীরে সবাই নিরাপদ দুরত্বে সরে গেছে। কিন্তু ছোট্ট শাবকটা নদীর স্রোতের মাঝে আটকা পড়ে থরথর করে কাঁপছে।
হয়তো বৃষ্টির জন্যই আজ গ্ৰামবাসিরা এখনো কাজে আসেনি। নয়তো এসময় হস্তিযূথ বনে ফিরে যায়, মানবসন্তানরা দখল নেয় এই অঞ্চলের। কখনো বেলা হয়ে গেলে ওরা আটকা পড়ে যায় মানুষদের ঘেরাটোপে।
লম্বদন্ত একবার চাবাগানের মাঝে এভাবেই আটকা পড়েছিল। মানুষগুলো ঢিল ছুড়ে, আগুন জ্বালিয়ে, বাঁশ দিয়ে খুচিয়ে উত্যক্ত করছিল দলটাকে। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছিল ওদের দেখার লোভে। লম্বদন্ত আর ঔদরিক পুরো দলটাকে পাহারা দিচ্ছিল। কখনো শুড় উচিয়ে ছুটে গিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল ঐ দোপেয়ে অসভ্য জানোয়ারগুলোকে। মাটি ছিটিয়ে প্রতিবাদ করছিল সবাই। সারাটা দিন খাওয়া নেই দাওয়া নেই বিশ্রামহীন কেটেছিল চা বাগানের ভেতর। সন্ধ্যায় অন্ধকার নামতেই ক্লান্ত মানুষ গুলো আস্তে আস্তে ফিরে গেছিল। তখন দলটাও বনের পথ ধরেছিল।
কিন্তু এবারের বিপদ যে একদম অন্যরকম। জল না কমলে শাবকটাকে উদ্ধার করা অসম্ভব। ওদিকে গুরগুরির মা বক্রতুণ্ডি করুণ স্বরে ডেকেই চলেছে। জলের ধারে দাঁড়িয়ে ভেজা চোখে সন্তানের দিকে চেয়ে রয়েছে এক মা। বৃষ্টির দাপট একটু কমলেও সূচের মতো জলের ফোটাগুলো বিধছে শরীরে, সঙ্গতে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপট। লম্বদন্ত অসহায় চোখে চারদিকে তাকায়। দু পা এগিয়ে জলের গভীরতা মাপতে চায়। কিন্তু জল আরো বাড়ছে। একটু আগে যে পাথরের উপর সে দাঁড়িয়ে ছিল তা জলের টানে ভেসে গেছে। হঠাৎ চোখে পড়ে বড় গাছের গুড়িটার দিকে। জলের স্রোতে ভেসে এসে পাথরের খাঁজে আটকে গেছে। বেশ লম্বা গুড়িটাকে টেনে নেয় লম্বদন্ত। এরপর ওটাকে লম্বালম্বি গুড়গুড়ির দিকে ভাসিয়ে দেয়। কয়েকবারের চেষ্টায় ওটা আটকে যায় পাথরের খাঁজে। দূরে একটা যন্ত্রদানবের আর্তনাদ শোনা যায়। ঝমঝম করে ওধারে ব্রিজের উপর দিয়ে ছুটে যায় গতিশীল লৌহদানব। গুড়িটাকে ততক্ষণে শুড় দিয়ে যাপটে ধরেছে গুরগুরি। কিন্তু ঐ ঘোলা জল যেভাবে পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ছে তা দেখে দুবার পা নামিয়েও তুলে নিলো। একটা দুটো করে লোক হচ্ছে ক্ষেতের ধারে। ভোঁ করে চাবাগানের মেশিন ঘরের সাইরেন বেজে উঠতেই দলটা চঞ্চল হয়ে উঠল। এরপর চা বাগানে পাতা তুলতে নেমে পড়বে কুলির দল। ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। লম্বদন্ত এবার নিজেই নেমে পড়ল জলে। গুড়িটাকে শুড় দিয়ে ধরে শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে এগিয়ে গেলো বড় পাথরটার দিকে। ভালোই টান রয়েছে জলে। গুরগুরির পক্ষে এভাবে একা ফেরা সম্ভব ছিল না, সামনের দু হাত জলের গভীরতা আরো বেশি।
হঠাৎ পেছনের থেকে শুড় দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে দলের কেউ। একটু বেঁকে ঘাড়টা তুলে লম্বদন্ত দেখে, মদমত্ত, বক্রতুণ্ডি সহ আরো অনেকজন মা হাতি শুড়ে শুড়ে পা জড়িয়ে এক শৃঙ্খল রচনা করে এগিয়ে এসেছে। ওদের সাহায্যে সে পৌঁছে যায় শাবকের কাছে। সারা গায়ে শুড় বুলিয়ে ভরসা দেয় ও গুরগুরিকে। তারপর ওকে তুলে দেয় গাছের গুড়ির উপর। একই ভাবে সবাই মিলে পারে তুলে নেয় ছোট্ট ছানাকে। ওধারে যে দোপেয়ে মানুষের দলটা এতোক্ষণ ওদের লক্ষ করছিল তারা হাততালি দিয়ে ওঠে। লম্বদন্ত একবার সেদিকে তাকিয়ে শুড়টা তুলে ডেকে ওঠে, মানুষগুলোর চোখেমুখে খুশির ছোঁয়া। লম্বদন্ত জানে মানুষ মাত্রেই খারাপ হয় না। শেষবার ওদের দেখে শুড় নাড়িয়ে দ্রুত দলটা ফিরে চলে বনের পথে। ছানা দুটো এবার মায়েদের পেটের নিচে নিশ্চিত আশ্রয়ে ঢুকে এগিয়ে চলেছে। আর বিরক্ত করছে না। টিপটিপ বৃষ্টিতে বনের আড়ালে নিরাপদে ফিরে যায় হস্তিযূথ। এভাবেই ওরা বেঁচে থাকার লড়াই চালায় প্রতিনিয়ত।
কলমে - দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায় ।





Comments