বিনসর বৃত্তান্ত
- dbwebdesk
- Nov 18, 2020
- 4 min read

পন্তনগর এয়ারপোর্টে নেমে বেশ হাড়কাঁপানো হিমেল বাতাসের স্পর্শ অনুভব করলাম আমরা। জুন মাস। কিছুক্ষণ আগেই বেশ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়েছে এখানে। জলে ভেজা পাথুরে রাস্তা আর আশেপাশের গাছপালা থেকে অদ্ভুত একটা নেশা ধরানো বুনো সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে।
আমাদের গন্তব্য এখন বিনসর। উত্তরাখন্ডে হিমালয়ের সান্নিধ্যে শান্ত, স্নিগ্ধ এক অরণ্যভূমি। এখান থেকে দূরত্ব প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। একটি বছর তিরিশের স্থানীয় গাড়ি-ড্রাইভারের সঙ্গে দর কষাকষির পালা সাঙ্গ করে অবশেষে গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা। টুটুনের চোখে-মুখে আনন্দ ঝলমল করছে।আমার কোলের কাছে ঘেঁসে বসলো ও।
গাড়িতে যেতে যেতে অপরূপ প্রাকৃতিক শোভাটুকু মিস করা যে কতখানি বোকামির কাজ- সেটা বুঝেই, যতটা সম্ভব নিজেকে সতেজ রাখার চেষ্টায় ঘুমজড়ানো চোখদুটো বড় বড় করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে টুটুন। দেখে বেশ হাসি পাচ্ছে। তার ছোট্ট বোনটি এতক্ষণ আমার কোলের মধ্যে ঘ্যান ঘ্যান করছিল... গাড়ি চলা শুরু হতেই ঘুমিয়ে পড়লো আমার কোলে শুয়েই। ওর আর কি দোষ? তার এক বছরের ক্ষুদ্র জীবনে বেড়াতে আসার অভিজ্ঞতা এই প্রথমবার ।
গাড়ি ছুটে চলেছে বিনসরের দিকে। চারিদিকে ওক, রডোডেনড্রন, পাইন, দেবদারুর বনভূমি। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে দেখে। মুহূর্তে যেন শহুরে জীবনের একঘেঁয়েমিগ্রস্ত বিষাদগুলো উধাও হয়ে টাটকা বাতাস এসে রক্তে মিশলো।
শুধুমাত্র ছবি দেখেই বুক করেছিলাম বনবাংলো টি। কেমন হবে- তা নিয়ে একটু হাল্কা উদ্বেগ কাজ করছিলো মনের ভেতর। গাড়ি এসে থামলো যখন নির্দিষ্ট গন্তব্যে, উদ্বেগের ঘোরটা অনেকটাই কেটে গেল। বেশ ছিমছাম সাজানো গোছানো বাংলোটি। অনেকটা ছবির মত।
অদ্ভুত একটা কাব্য-সৌন্দর্য আছে জায়গাটির। এখান থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে আলমোড়ায় বসে রবিঠাকুর লিখেছিলেন-‘এই মাটিতে রইল তাহার বিস্মিত প্রণাম...’ ;
বাংলোর রুমে ঢুকে স্নান সেরে দেশি মুরগীর ঝোল দিয়ে লাঞ্চটি ভালোমতই উপভোগ করলাম। আমাদের অনুরোধে ১ বছরের কেকার জন্যে বেশ উপাদেয় খিচুড়িও বানিয়ে দিয়েছিল এরা। একটু গড়িয়ে নেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল যদিও.... কিন্তু শুনলাম- সন্ধ্যার পর এখানে বিদ্যুৎ থাকেনা। তাছাড়া, এই জঙ্গলভূমিতে পায়ে হেঁটেই অনেকটা পথ যাওয়ার আছে। আশেপাশে বুনো শুয়োর আর বার্কিং ডিয়ারের দেখা মিলতে পারে।
কাজেই, আর সাতপাঁচ না ভেবে চটপট রেডি হয়ে রিসেপসনে গিয়ে হাজির হলাম। গাইড বুধুয়া আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্যে। আমাদের দেখে এগিয়ে এসে আলাপ করলো ছেলেটি। চোখে মুখে প্রাণখোলা হাসি। বয়স চব্বিশ পঁচিশের বেশি হবেনা। বেশ অনেকদিন ধরেই এই গাইডের কাজে লিপ্ত সে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে আমাদের সাথে কিছু কথোপকথন সেরে, আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলো সে।
একটু টেনসনে ছিলাম কেকা কে নিয়ে। অতটুকু বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঐ চড়াই উতরাই সত্যিই কঠিন আমাদের পক্ষে। কেকারাণী কিন্তু দিব্য প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে খিলখিলিয়ে হেসে যাচ্ছেন কখনও মা, আবার কখনও বাবার কোলে চড়ে। বুধুয়া আমাদের অসুবিধা টা বুঝতে পেরে নিজেই এগিয়ে এলো।
-"লাইয়ে ম্যাডামজি, ইয়ে মেরে সাথ জায়েগি।"
আমরা একটু ইতস্তত করলেও, সেসবের তোয়াক্কা না করে কেকাকে অত্যন্ত সাবলীলভাবে নিজের কাঁধে উঠিয়ে এগিয়ে চললো বুধুয়া। মুখে হাসি, বুকে গর্ব.... নিজের মাটির গর্ব। ওর সাথে পা-এ পা মিলিয়ে উঁচু রাস্তায় উঠতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠছি আমরা দুই শহুরে কেতাদুরস্ত দম্পতি। কাজেই একটু পিছিয়ে হাঁটছি আমরা । কেমন একটা চাপা ঈর্ষা হচ্ছে ঐ জংলী ছেলেটার ওপর। আমাদের সাত বছরের খুদে ওস্তাদ কিন্তু একবুক উদ্দীপনা নিয়ে বুধুয়ার পাশাপাশি হেঁটে চলেছে।
রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো হলুদ গাছের পাতাগুলো আমাদের পদপিষ্ট হয়ে চির্ চির্ আওয়াজ হচ্ছে। সেই আওয়াজের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কাছ থেকে, দূর থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন রকমের পাখীর ডাক। বুধুয়াও থেকে থেকে তাল মিলিয়ে হরবোলার মত আওয়াজ বের করছে মুখ থেকে। যেন এই জঙ্গলের সমস্ত পশুপক্ষী ওর নিকটাত্মীয়। ব্যাপার দেখে মাঝে মাঝেই হেসে উঠছে ওর কাঁধে বসে থাকা কেকা। টুটুন তো লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে বুধুয়ার আগে আগে-ঠিক যেন এখানকার ই কেউ।
চারপাশের মায়াময় প্রকৃতি যেন অদ্ভুতভাবে সম্মোহিত করে তুলছে পিছনে হেঁটে চলা আমাদের দুজনকে। কখন যে চলতে চলতে নিজেদের অজান্তে দুজন দুজনের হাত ধরে ফেলেছি! ....টের-ই পাইনি। কতদিন পর এমন নিবিড়ভাবে হাত ধরলাম আমরা!!
কারোর মুখে কোনও কথা নেই... এমনি মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বুধুয়ার ডাকে ঘোর কাটলো। বুধুয়া আঙুলের ইশারায় একটা ওয়াচ টাওয়ার দেখিয়ে সেখানে উঠে যেতে বললো। ওর কাছ থেকে কেকা কে নিয়ে উঠে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারের ওপর। এই সেই জায়গা- যেখান থেকে হিমালয়ের অনেকগুলো শৃঙ্গ একসাথে দেখা যায়। ভাগ্যক্রমে এখন আকাশ বেশ পরিষ্কার, স্বচ্ছ।
মুগ্ধতা জিনিসটা অনেকটা প্রেমের মত। আগে থেকে জানান না দিয়েই হঠাৎ করে এসে মনকে পবিত্র করে তোলে। উপরে ওঠার পরে আবার হঠাৎ করে নতুনভাবে মুগ্ধতার বশীভূত হলাম আমরা.... দ্য গ্রেট হিমালয়ান রেঞ্জ.... ‘স্বর্গ’ কি এরই নাম? বাকরুদ্ধ হয়ে ক্যামেরাবন্দী করে চলেছি অনবদ্য মুহূর্তগুলোকে। কোনও অজ্ঞাত চিত্রকর তাঁর যাদুতুলি দিয়ে যেন এইমাত্র আকাশের বুকে এঁকে গেছেন ঐ শৃঙ্গরাশি। বুধুয়া উঠে এসে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শৃঙ্গগুলি চিহ্নিত করতে থাকলো..... পঞ্চচুল্লী, নন্দাদেবী, চৌখাম্বা....
বেশ অনেকক্ষণ কাটালাম সেখানে। মাথার ওপর দিয়ে একদল বকজাতীয় পাখী কোলাহল করতে করতে উড়ে গেল। সূয্যিমামার অস্ত যাবার সময় হয়েছে। বুধুয়া একটা আঞ্চলিক ভাষায় গান ধরলো। কথাগুলো বুঝতে না পারলেও সুর টা বড় মন ছুঁয়ে যাচ্ছে । সবকিছুই এখানে যেন আশ্চর্যভাবে সমন্বিত । বিকেলের পড়ন্ত আলো গিয়ে পড়ছে চারপাশের গোলাপি রঙের ফুলগুলোর ওপর। রডোডেনড্রন ফুল। বুধুয়ারা বলে ‘বুরানশ’।
আমাদেরকে বাংলো পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে সেদিনকার মত বিদায় নিলো বুধুয়া। পরের দিন ‘প্যাংগট’ নামে একটা জায়গায় নিয়ে যাবে আমাদের... যেখানে গেলে নাকি বিভিন্ন রকমের পাখী দেখা যায়। (সেই বিবরণ আর এ গল্পে দিলাম না.. এই লেখা শুধুমাত্র বিনসর-কে কেন্দ্র করেই।)
দুদিন এখানে থাকার পরে নৈনিতাল যাবার প্ল্যান আমাদের । চলে যাবার কথা ভাবলেই কেমন ভারাক্রান্ত হয়ে আসছে মনটা! এই অল্প সময়েই যেন এক অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে জায়গাটার সাথে....
কিন্তু ফিরতে যে হয়ই অবশেষে নিজের শিকড়ের কাছে- সেটাই চরম সত্যি... বুকের ভেতরের সিন্দুকে গুপ্তধনের মতন সযত্নে আগলে রাখা থাকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতাগুলো।
তবে সেই অদৃশ্য সুতোটা কিন্তু এখনও থেকেই গেছে। মাঝে মাঝেই যখন কর্ব্যমস্ততার মধ্যেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেইসব টুকরো টুকরো দৃশ্যপট, হিমালয়ের শৃঙ্গরাশি, গোলাপি রডোডেনড্রন ফুল, কানে ভাসে বুধুয়ার গানের সুর, তখন টান পড়ে সেই সুতোটায়... হাতছানি দিয়ে ডাকে সেই স্নিগ্ধ অরণ্যভূমি- বিনসর।
কলমে - নীলাঞ্জনা মল্লিক ।





Comments